২০ শে ডিসেম্বর ২০০৭ ইং তারিখে ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশের বাড়িতে রওনা দিলাম। আমি,ভাইয়া ও আমার মামা। গাবতলি গিয়ে দেখি প্রচুর লোকের ভীড়। অনেক কষ্টে ভাইয়া তিনটা টিকেট কাটল। ফেরী পারাপারের কোন গাড়ি পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়েই লঞ্চ পারাপারে গাড়ি নিতে হল। তারপরেও বেশ ভালই লাগছিল। বাড়িতে যাচ্ছি একথা মনে পড়তেই আনন্দে হৃদয়টা নেঁচে উঠছিল বার বার। একসময় গাড়ি হঠাৎ থেমে গেলো। কি হয়েছে? কি হয়েছে? বাস থেকে নামলাম। নেমে মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম। মামা বলল “প্রচন্ড ট্রাফিক জ্যাম একদম আরিচা ঘাট পর্যন্ত”। আমি মামাকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম “মামা এই স্থানটির নাম কি?”মামা বলল, “মানিকগঞ্জ" । তার মানে মানিকগঞ্জ থেকে শুরু করে একটানা আরিচা ঘাট পর্যন্ত জ্যাম। এখন কি করি?”
অবশ্য মনে মনে ভালই লাগছিল। একপাশে ঘর-বাড়ি,গাছ-পালা এক কথায় গ্রাম, আর এক পাশে ধূ ধূ করা মাঠ। আর সেই মাঠে হলুদ কার্পেট বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। হলুদ সরিষার ফুলে মাঠ ভরেগেছে। একটানা চার ঘন্টা পথ ধরে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম আরিচার দিকে। এক সময় জ্যাম ছাড়ল। আরিচায় পৌঁছে গেলাম। লঞ্চ ঘাঁটে পৌঁছে দেখি শুধু মানুষ আর মানুষ। ভাইয়াকে বললাম “ভাইয়া কিভাবে যাব? এ দেখি হাঁটা পর্যন্ত অসম্ভব। তারপরেও দেখি লঞ্চের অভাব। যে পরিমান লোক, তার উপযুক্ত পর্যাপ্ত পরিমান লঞ্চ নেই। নেই লঞ্চ, নেই নদী পথের অন্য কোন যানবাহন, নেই উপযুক্ত নিয়ম শৃঙ্খলা। আছে শুধু মানুষ আর মানুষ। ভাইয়া বলল “ট্রলারের ব্যবস্থা করতে হবে। নয়ত লঞ্চে ঢুকলে মানুষের চাপেই মারা যাব।”
কথাটা প্রায় ৯০% সত্যি হচ্ছিলো। অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। যাই হোক বললাম যে টার্মিনালে ঢুকবোনা। কিন্তু কিভাবে যে র্টামিনালে ঢুকলাম তা আমরা নিজেরা ও জানি না। মামা বলল, “ঢুকে যখন পড়েছি বেরোনো যাবে না”। একথা বলতে না বলতেই পিছন থেকে ঢেউ এর মত একটা ধাক্কা এল। চলে গেলাম অনেক দূরে। অনেকক্ষণ পর একটা লঞ্চ আসল। চোখের পলকে লঞ্চটা চলেও গেল। তার মানে লঞ্চ আসতে দেরি যেতে দেরি নাই। হঠাৎ চিৎকার শুনলাম। হালকা করে যা দেখলাম, তাতে বুঝলাম একজন মহিলা ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছে। তার পরনে ছিল শাড়ি। মধ্যবয়স্ক সেই মহিলা মানুষের পায়ের নিচে আহাজারী করছে কিন্তু উঠতে পারছে না। সেই সময়টার এমন অবস্থা ছিল যে, মানুষ তাকে হাত ধরে উঠাবে কি? তার গায়ের উপর দিয়ে সবাই লঞ্চে উঠছে। অনেকক্ষণ পর পর একটি লঞ্চ আসছে। আর মানুষ যে কিভাবে উঠছে তা শুধুমাএ স্বচোক্ষে দেখানো ছাড়া লিখে বোঝানো যাবে না। আমার হাতে ছিল দুটি ব্যাগ, মামার হাতে ছিল একটি ব্যাগ, ভাইয়ার হাতেও একটি ব্যাগ। অবশ্য তাদের ব্যাগ গুলো ছিল বড়। আর আমার হাতের ব্যাগ ছিল ছোট। হঠাৎ একটা লঞ্চ এল, মানুষ উঠছে। হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেলাম। মায়ের কোল থেকে বাচ্চা ছিটকে গিয়ে পানিতে পড়ে গেলো। লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে। মা চিৎকার করে উঠলো। অমনি দুটো লোক পানিতে ঝাপ দিয়ে পড়ল। বাচ্চাটাকে সঙ্গে সঙ্গে উঠালো। চোখ ফেরাতে না ফেরাতেই দেখলাম আর একজন মহিলা পড়ে গেলো পানিতে। অবশ্য তাকেও উঠানো হয়েছে। কিন্তু এই যে হয়রানি এটা থেকে রক্ষা দেবে কে? সামান্য কিছু নিয়ম শৃঙ্খলার অভাবে হাজারো মানুষের প্রাণ ভেসে যাচ্ছে যাওয়ার একমাত্র পন্থা এই আরিচা ঘাঁট। যাইহোক আরিচা ঘাটে দেখা হয়েছিল আমার এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে। ধরিয়ে দিলাম ওর হাতে আর একটা ব্যাগ। ও আমাদের অনেক সাহায্য করেছিল। এল পিছন থেকে আর ও একটি ধাক্কা। আমরা মোট চার জন ছিলাম কিন্তু ধাক্কা খেয়ে চারজন চারদিকে ছিটকে পড়লাম। আমি ভাইয়ার হাত ধরেছিলাম। এখন আর কাউকে দেখিনা। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছিলাম। আমি চিৎকার দিলাম। ভয়ে কেঁদেও ফেললাম।
হঠাৎ একটা ছেলে আমার হাত চেপে ধরে বলল, “ভয় নেই তোমার, আল্লাহ ভরসা”। বুকে একটু সাহস এল। খেলাম আর একটা ধাক্কা। চলে গেলাম লঞ্চের মাথায়। যাই হোক কথায় বলে না? আমি লঞ্চের মাথায় উঠলাম কি নদীতে পড়ে যাচ্ছিলাম। আর অমনি সেই ছেলেটি আমার হাত চেপে ধরলো। ছেলেটি হাত না ধরলে আমি নির্ঘাত লঞ্চের নিচে চলে যেতাম। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে টেনে উপরে উঠালো। আমি নতুন জীবন ফিরে পেলাম। সত্যি বলতে কি যখন পড়ে যাচ্ছিলাম বা মানুষের চাপের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম তখন ভাইয়া মামার কার ও কথা মনে ছিলনা। শুধু নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ শুরু করলাম। যাইহোক যখন লঞ্চে উঠে এক পাশে ছেলেটা আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলো ঠিক তখনই আমার ভাইয়ার কথা মামার কথা মনে পড়ে গেলো। এখন চিন্তা করছি ভাইয়া কোথায়, মামা কোথায়? কাঁদতে লাগলাম। ছেলেটি আমাকে সান্তনা দিতে লাগল। জিজ্ঞাসা করল, “তোমার সাথে আর কে আছে? ” আমি বললাম,“আমার ভাইয়া আর মামা। ছেলেটি বলল,তারা হয়ত ভালভাবেই আছে। আমি কাঁদছি আর বলছি তারা ভাল থাকবে কিভাবে? তারা তো চাপেই মরে যাবে। আমি কাঁপছি। ছেলেটির সাথে ছিল আরো দুজন। জানিনা তারা সর্ম্পকে আত্নীয় কিনা। ওদের মধ্যে একজন আমাকে পানি দিল। বলল “চিন্তা করবেন না,পানি পান করুন। ব্যবস্থা একটা হবেই। ছেলেটা বলল তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমি বললাম, “আমি তো সাঁতার জানি না ”।
ছেলেটা বলল, “আমরা ও জানিনা। তুমি পড়ে গেলে কি আমরা বসে থাকতাম। আবার বলল আমরা তো আছি ভয় কিসের? তোমার ভাইয়ার সাথে দেখা না হলে, আমরা তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব, তোমার বাড়ি কোথায়?” আমি বললাম “মাগুরাচসে”
ছেলেটি বলল, “সমস্যা নেই আমি বাড়ি ঐদিকেই। তারপরেও সে আর একটি স্থানের নাম নাম বলছিল। হয়ত তার থানার নাম অথবা গ্রামের নাম। কিন্তু ভাগ্য খারাপ আমার তা মনে নেই। কিছুক্ষণ পরে মামাকে দূর থেকে দেখলাম। ঐ একই লঞ্চে মামা। মামা আমাকে খুঁজছে। আমি দেখতে পাচ্ছি কিন্তু ডাকতে পারছি না। ছেলেটা আমাকে বলল, “তোমার ব্যাগ দুটো আমরা দেখছি, “তুমি তোমার মামাকে খুঁজে নিয়ে আস”। আমি ভীড়ের মধ্যে ঠেলে আস্তে আস্তে গেলাম। মামা আমাকে দেখলো আর বলল,“মা ভয় নেই তোর। তুই ওখানেই থাক, আমি রিপনকে ফোন দিচ্ছি কিন্তু পাচ্ছি না।”
রিপন আমার ভাইয়ার নাম। আমি তখন আরো ভয় পেয়ে গেলাম। ছেলেটার কাছে ফিরে এলাম। আমাকে জিঞ্জাসা করলো “পেয়েছেন”? আমি বললাম, “পেয়েছি।”
লঞ্চ ঘাঁটে ভিড়ল। ভাবলাম নামতেও মনে হয় অনেক কষ্ট হবে। কিন্তু তা আর হল না। ছেলেটার সাথে ভাল ভাবেই নামলাম। মামার সাথে ছেলেটার পরিচয় করিয়ে দিলাম। পরিচয় আর কি? বললাম উনার উছিলায় আমি মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা পেয়েছি। ভীড়ের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের গাড়ির কাছে পৌছে গেলাম। কিন্তু আমি কাদঁছি ভাইয়ার জন্য। মামা আমাকে সান্তনা দিল। ছেলেটা মামার কাছ থেকে বিদায় নিল। আমাকে শুধু বলল আসি। আমি মাথা নাড়ালাম। কিছুই বলতে পারলাম না। গাড়িতে উঠলাম। আশেপাশের সিটের সবাই ভাইয়াকে ফোন দিচ্ছে কিন্তু পাচ্ছে না। অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পর ভাইয়া আসল। গাড়ি ছেড়ে দিল। চাচাতো ভাইটাকে ও পেলাম। কিন্তু আমার মনের মধ্যে একটাই ভাবনা হচ্ছিল। ছেলেটাকে ভাল করে একটা ধন্যবাদ ও দিতে পারলাম না। নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছে। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। হয়ত বা সে এ ঘটনা ভুলে যেতে পারে কিন্তু আমি ভুলতে পারবনা। তার সাথে হয়ত কখনো দেখা হবেনা। কিন্তু তার ব্যাবহার, তার উপকার মনে থাকবে আমার আজীবন।
এই যে, কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাবে মানুষের জীবন চলে যাওয়া অথবা মানুষের এই যে হয়রানি এ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় আছে কি? সরকার এত কিছুর সু-ব্যাবস্থার পদক্ষেপ নিয়েছে কিন্তু সাধারন সু-ব্যাবস্থার অভাবে বড় কিছু ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থার দিকে একটু দৃষ্টি দিলে হয়ত সাধারন মানুষ সস্তি পাবে। যেমন নদীপথের যানবাহনের সু-ব্যাবস্থা বিশেষ করে র্টামিনাল গুলোকে আরও প্রসার সুন্দর নিয়মের দ্বারা বেঁধে দিলে এসব হয়রানীর হাত থেকে সাধারন মানুষ বেঁচে যাবে।